হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক সমৃদ্ধ ভূখণ্ড এই বাংলাদেশ। আর বাংলার সেই চিরায়ত শিল্প-সংস্কৃতির আলিঙ্গনে শনিবার থেকে শুরু হলো গণজাগরণের ঐত্যিবাহী নাট্য উৎসব। দর্শক-শ্রোতার হৃদয় রাঙিয়ে প্রথম দিনের আসর মাতিয়েছেন ইসলাম উদ্দিন পালাকার। বাংলাদেশ লোকসংস্কৃতির অন্যতম বিলুপ্তপ্রায় উপাদান সংরক্ষণে বৃহৎ পরিসরে সজ্জিত হয়েছে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত এ উৎসব। শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল থেকে সূচনা হওয়া আট দিনব্যাপী জাগরণমূলক আয়োজনটি পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হবে দেশের ৬৪ জেলায়।
এ আয়োজনে দর্শকরা দেখা মিলকে আপন সংস্কৃতির ঐতিহ্যময় কিচ্ছাপালা থেকে শুরু করে বিচারগান, জারিগান, যাত্রা, আলকাপ, গম্ভীরা, পালাটিয়া, ধামাইল, ধাপের গান, অষ্টক, গাজীরগীত, ইমাম যাত্রা, পটের গান, মাদার পীরের গান, বেহুলার নাচাড়ী, সংযাত্রা, মঙ্গলচ-ীর গান, রয়নী, কুশান, সত্যপীরের গান, ঝাপানগান, পদ্মার নাচন, পদ্মাপূরাণ, মনসামঙ্গল, নটপালা, কীর্তন, ধামের গান, ধুয়াগান, পুতুলনাচ, হাইল্ল্যাগীত, ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী পরিবেশনা (গেংঘুলি, পাংখু, হাচুক মাইকাতাল, বিহু), ভাসানযাত্রাসহ নানা ধরনের নাট্য আঙ্গিক। সংস্কৃতিচর্চার মূলধারায় এসব শিল্প আঙ্গিককে সংযুক্ত করা এবং এই শিল্পের শিল্পীদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ উৎসব।
উদ্বোধনী আলোচনায় মফিদুল হক বলেন, সংস্কৃতির শক্তিশালী মাধ্যম হলো লোকসংস্কৃতি; যার অন্যতম একটি শাখা ঐতিহ্যবাহী নাটক। চিরায়ত গ্রাম-বাংলার পালাকার বা গায়েনদের সহজ সরল উপস্থাপনায় পরিবেশিত এই ঐতিহ্যবাহী নাটক সমাজ সংস্কার ও লোকশিক্ষার অন্যতম বাহন। এটি যুগে যুগে যা তার যুগপরম্পরা উপস্থাপনা ও প্রয়োগশৈলীর মাধ্যমে বিষয়বস্তু, সময় এবং পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষের আত্মিক উন্নয়নসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের সামষ্টিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হয়েছে। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সর্বসাধারণকে সম্পৃক্ত ও অনুপ্রাণিত করতে বিষয়ভিত্তিক এই ঐতিহ্যবাহী নাটকের প্রদর্শনী অত্যন্ত কার্যকরী কৌশল। সারা বিশ্বে যা উন্নয়নের জন্য নাটকের একটি অন্যতম বাহন হিসেবে চর্চিত হয়ে আসছে।
লিয়াকত আলী লাকী বলেন, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের টেকসই রূপায়ণে সকল শ্রেণি, সম্প্রদায়ের মানুষকে সম্পৃক্ত ও অনুপ্রাণিত করতে শিল্পকলা একাডেমি দেশব্যাপী ৬৪ জেলার গ্রাম-বাংলায় চলমান পরিবেশনার মধ্য থেকে ১টি করে ঐতিহ্যবাহী নাট্য আঙ্গিক বাছাই করেছে। এই বাছাই প্রক্রিয়ায় একদল গবেষক নিষ্ঠার সঙ্গে শ্রম দিয়েছে। প্রতিটি জেলার বাছাইকৃত নাট্য আঙ্গিক ওই জেলার একটি গ্রামে প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে দেশব্যাপী এই ঐতিহ্যবাহী নাট্যোৎসব আয়োজন করা হয়েছে। আগামী ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে জেলা শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় এই উৎসব আয়োজিত হবে।
উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে পরিবেশিত হয় কিচ্ছাপালা ‘কমলা রাণীর সাগর দীঘি’। গানের সুরে সুরে ও বিশেষ অঙ্গ ভঙ্গিমায় পরিবেশনাটি উপস্থাপন করেন ইসলাম উদ্দিন পালাকার। সে পরিবেশনায় উঠে আসে কয়েক শতাব্দী পূর্বে মৌলভীবাজারের রাজনগর এলাকার দীঘি খনন নিয়ে রচিত ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ।
আজ রবিববার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে উৎসবের দ্বিতীয় দিনের পরিবেশনা শুরু সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। এদিন ‘সংযাত্রা’ পরিবেশন করবেন টাঙ্গাইলের শ্রী ভঞ্জন পাল। সোমবার তৃতীয় দিনে ‘আলকাপ’ পরিবেশন করবেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিল্পী লুৎফর সরকার। মঙ্গলবার ‘পালাটিয়া : আপেল মাতাজির পূর্ণা কুটুম’ পরিবেশন করবেন দিনাজপুরের শিল্পী প্রতিভা পালাটিয়া। ৮ দিনব্যাপী এ উৎসব আয়োজনের ভাবনা ও পরিকল্পনা করেছেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। উৎসব সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
নাট্যকার মান্নান হীরা স্মরণ ॥ শনিবার ছিল পথনাটকের খ্যাতিমান নাট্যকার ও বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের সভাপতি নাট্যজন মান্নান হীরার তৃতীয় প্রয়াণবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির মুক্তমঞ্চে বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ মান্নান হীরাকে নিবেদিত শ্রদ্ধা ও স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করে।
আক্তার উজ জামান কিরণের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি লেখক ও গবেষক গোলাম কুদ্দুছ, পথনাটক পরিষদের সহ-সভাপতি অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী, পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহাম্মেদ গিয়াস ও মান্নান হীরার সহধর্মিণী সৈয়দা নাদিরা মান্নান। সভাপতিত্ব করেন পথনাটক পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান।
আলোচনা শেষে মান্নান হীরা রচিত পথনাটক ‘ইদারা’ পরিবেশনা করে উৎস নাট্যদল। এ ছাড়াও নাট নন্দন ও খেয়ালি নাট্য সম্প্রদায়ের পথনাটক পরিবেশন করে।