১৯৭৫ এর ১০ আগষ্ট আমার ছোটোভাই জিন্নার বিয়ে ছিল। বিয়ে রাজশাহীতে বৌভাত বগুড়ায় (বগুড়ায় আমার বাবার বাড়ি)। ১৫ আগষ্ট ঢাকা যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু তার পরিবারসহ অন্যান্যদের হত্যার খবর শুনলাম। ফেরী বন্ধ থাকায় ফিরে এলাম। দুই একদিন পর ঢাকায় গেলে এক আত্মীয় তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। কিন্তু সেখানে নিরাপদ মনে হলোনা। টেলিফোনের কারণে অস্থিরতা ছিল। উনি (শহিদ এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান হেনা) বললেন ‘আমিতো অন্যায় করিনি, আমার কিছু হবেনা’। ১৬ আগষ্ট বা তার পরের দিন সরকারি বাড়িতে গেলে সবাই হাউজ অ্যারেস্ট হয়ে গেলাম। টেলিফোন বিচ্ছিন্ন ২৩ আগষ্ট জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কিছু লোক এলেন। উনি শুধু এককাপ চা পান করলেন। এ সময় তাঁর হাত কাঁপছিল। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়ার পর কিছু লোক এসে বাড়ি তল্লাসী করল। এ সময় বাড়িতে আমি, আমার দুই মেয়ে রিয়া, চুমকি, ভাই জিন্না তার বৌ। দুই ছেলে পড়ালেখার জন্য তখন কলকাতায়। ওরা তল্লাসী করে চলে যাওয়ার পর পুলিশ কন্ট্রোলরুম থেকে জানলাম ওনাকে (শহিদ এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান হেনা) ঢাকা কারাগারে নেওয়া হয়েছে। উনি ছিলেন সাদামাটা একজন মানুষ। মাছ সবজি দিয়ে ভাত খেতেন। রাতে একটা রুটি আর মুরগির গোস্ত খেতেন। চিনি ছাড়া লেবু দিয়ে চা, পান খেতে ভালোবাসতেন। দুই সপ্তাহ পর অর্থাৎ পনেরো দিন পরপর বিশ মিনিটের জন্য দেখা করার সুযোগ পেতাম। যা যা মনে করে যেতাম ওখানে গিয়ে সব ভুলে যেতাম। কেউ আমাদের বাড়ি ভাড়া দিতে সাহস না পাওয়ায় ঢাকার ভুতের গলিতে কচুরিপানার মধ্যে একটি বাড়ি পেলাম। জেলখানায় ওনার সাথে দেখা করতে যাবার সময় ওনার লেখালেখির জন্য অনেক কাগজকলম নিয়ে যেতাম। উনি আরো বেশি কাগজ-কলম চাইতেন। ‘মুখটা খুলতেই চমকে গেলাম, কপালের ডানদিক ক্ষত। রক্তমাখা হাঁটু ঝুলে আছে বুকটা ঝাঁঝরা। কালো কম্বল ভাঁজ করে বুকটা জড়ানো।’ হতবাক হয়ে গেলাম। জেলখানা নাকি নিরাপদ স্থান। অথচ ঘুম থেকে তাকে ডেকে ঝাঁঝরা করে দেয়া হল। তিনিতো ছিলেন নরম মানুষ। একটা গুলিই যথেষ্ট ছিল। লাশ রাজশাহীতে আনার জন্য হেলিকাপ্টার না পেয়ে ট্রাক বা বাসে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। লাশ দুইদিন জেলখানাতেই থাকলো। ঢাকার পুরানো তেজগাঁও বিমানবন্দরে কফিনে চা পাতা দিয়ে তার লাশ রাখা হয়েছে। ‘মুখটা খুলতেই চমকে গেলাম, কপালের ডানদিক ক্ষত। রক্তমাখা হাঁটু ঝুলে আছে। বুকটা ঝাঁঝরা। কালো কম্বল ভাঁজ করে বুকটা জড়ানো।
৬ নভেম্বর দুই মেয়েসহ হেলিকপ্টারে লাশ নিয়ে রাজশাহীতে এলাম। কঠোর কড়াকড়ি শ্বশুর বললেন ‘লাশ দেখবোনা, ওর আগের চেহারাটাই মনে থাক’। কড়াকড়ির মধ্যেও দুই একজন এসেছিলেন। সেনাবহিনীর পাহারায় কফিনসহ লাশ দাফন করার পর ওরা এক সপ্তাহ পাহারা বসালো, যদি কেউ লাশ তোলে মিছিল করে। আহা! লোকটা তো খুব নরম ছিল, তাঁর জন্য একটা গুলিই যথেষ্ট ছিল। দুঃখ তার গায়ে একটুও পানি ঢালা হল না। ঢাকা গিয়ে জেলখানা কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর থালাবাটি পেলাম। কিন্তু ডায়েরি পাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। সারাবছর কেউ খোঁজ রাখে না। ৩ নভেম্বর এলেই শুরু হয় সাংবাদিকদের অত্যাচার, নতুন করে যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয়। সকালে হাঁটতে গিয়ে শিউলি ফুলগুলি কুঁড়িয়ে নিয়ে এসেছি, হেমন্তের উপহার ভালো লাগে।
[১৯৯৫ সালে ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধুকালীন স্বরাষ্ট্র ত্রাণ ও পূনর্বাসন মন্ত্রী জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহিদ এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান হেনার পত্নী জাহানারা কামরুজ্জামানের সাথে ‘সাপ্তাহিক দুনিয়ার সম্পাদক সুলতানা শারমিনের আলাচারিতার অংশবিশেষ, গ্রন্থনা-ওয়ালিউর রহমান বাবু মুক্তিযুদ্ধের তথ্যা সংগ্রহ সমাজ ও সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজশাহী, ০১৯১১-৮৯৪২৬০]