আর্কাইভ কনভাটার ঢাকা, বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
alo

কণার নাম গোস্ট পর্টিকেল, শনাক্ত করতেও বহুদিন লেগেছিল, কী এই কণা?

Public Voice

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বর, ২০২৪, ০৪:২৫ পিএম

alo
alo

অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি, ‘অপবর্জন নীতি’র কারণে যিনি বিখ্যাত। এই পাউলিই প্রথম নিউট্রন কণার ভবিষ্যদ্বাণী করেন। ভবিষ্যদ্বাণীর পেছনে রয়েছে আরেক মজার ঘটনা। ১৯২৯ সাল। ডেনিস বিজ্ঞানী নীলস বোরের তখন জগেজাড়া খ্যাতি। পরমাণু মডেলের কারণে। বোর একটা পরামর্শ চেয়ে চিঠি লিখলেন পাউলিকে। বোর পাউলির চেয়ে ১৫ বছরের বড়, তত দিনে নোবেল পুরস্কারও পেয়ে গেছেন। তবু ২৯ বছর বয়সী জুনিয়র বিজ্ঞানীর কাছে পরামর্শ কেন? কারণ, পাউলি স্পষ্টবক্তা হিসেবে বিখ্যাত। কোনো বিজ্ঞানীর তত্ত্ব ঠিক মনে না করলে, সরাসরি বলে ফেলতেন তাঁর বক্তব্য। বলতেন ঠিক কোথায় অসঙ্গতি রয়েছে। পাউলি বোরের ধারণার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। জবাবে লিখেছিলেন, ‘বিকিরণ বিষয়ে আপনার ধারণা মোটেও সন্তোষজনক নয়। আপাতত ওটা ঘুমিয়ে থাকুক আর নক্ষত্ররা আলো দিক শান্তিতে...’ ভরশক্তির নিত্যতা সূত্র আছে। সেই সূত্র বলে, মহাবিশ্বের মোট ভরশক্তির পরিমাণ সব সময় এক। নতুন করে ভরশক্তির জন্ম দেওয়া যাবে না আবার মোট ভরশক্তির কমও হবে না। শুধু ভর আর শক্তিকে এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় রূপান্তর করা যাবে। কিছু মৌলিক পদার্থ তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে—আলফা, বেটা ও গামা রশ্মি। ফলে ভাঙন ধরে এদের নিউক্লিয়াসে। ভাঙনের পর সেই নিউক্লিয়াস অন্য পরমাণুর নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। আলফা ও গামা রশ্মি ক্ষয়ে কোনো সমস্যা দেখা যায় না। কিন্তু গোল বাধে বেটা রশ্মি বিকিরণের সময়। যেসব পরমাণু বেটা রশ্মি বিকিরণ করে, মনে হয় তারা ভরশক্তির নিত্যতা লঙ্ঘন করছে। ট্রিটিয়ামের কথাই ধরা যাক। ট্রিটিয়াম হলো একটা প্রোটন ও দুটো নিউট্রনযুক্ত হাইড্রোজেনের আইসোটোপ। ট্রিটিয়াম বেটা রশ্মি নিঃসরণ করে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। ফলে কিছুটা কমে যায় ট্রিটিয়ামের ভরশক্তি। অন্যদিকে কিছুটা ভরশক্তি নিয়ে পরমাণু থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় ইলেকট্রন বা বিটা রশ্মি। ট্রিটিয়ামের হারানো ভরশক্তি আর নিউক্লিয়াস থেকে ছুটে বেরিয়ে যাওয়া ইলেকট্রনের ভরশক্তি সমান হওয়া উচিত। কিন্তু হিসাব কষে দেখা গেল, বিটা রশ্মির ইলেকট্রনের ভরশক্তি কিছুটা কম। তাহলে বাকি ভরশক্তি গেল কোথায়? বিজ্ঞানীরা অনেক মাথা খাটিয়েও এর সমাধান বের করতে পারেননি। তখন ডেনিস বিজ্ঞানী নিলস বোর প্রস্তাব করলেন, ভরশক্তির নিত্যতা সূত্র কাজ করছে না এখানে। তাঁর যুক্তি, পরমাণুর ভেতরে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের অনেক সূত্রই খাটে না, তাই হয়তো ভরশক্তির নিত্যতা সূত্রও এখানে খাটবে না। এই প্রস্তাবটাই বোর জানিয়েছিলেন পাউলিকে লেখা চিঠিতে। পাউলি ভরশক্তির নিত্যতাকে বাদ দিতে চাইলেন না। কারণ, আলফা ও গামা রশ্মি বিকিরণের ভরশক্তির নিত্যতা বজায় থাকে। বোরের কথা মানলে সেখান থেকেও ভরশক্তির নিত্যতা সূত্র বাদ দিতে হয়। আর সেটা করতে গেলে পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানের অনেক বিষয়ই ওলট-পালট হয়ে যাবে। পাউলি একটু অন্যভাবে ভাবতে শুরু করলেন। ভাবলেন, হারানো ভরটুকু নিশ্চয়ই অন্য কোনো অদৃশ্য কণায় পরিণত হয়। সেই কণার চার্জ নেই। চার্জবিহীন কণা অন্য বস্তুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এ জন্য একে খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। চার্জযুক্ত ইলেকট্রন-প্রোটনের খোঁজ তত দিনে পাওয়া গেছে, কিন্তু নিউট্রন তখনো আবিষ্কার হয়নি। তবে বিজ্ঞানীরা এটা নিশ্চিত ছিলেন, বেটা ক্ষয়টা হয় নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে এবং সেটার জন্য প্রোটন দায়ী নয়। অন্য কোনো উৎস থেকে সেটা আসছে। পাউলি অঙ্ক কষে তাঁর তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। পাউলি তখন ব্যক্তিগত জীবনের নানা টানাপোড়েন জর্জরিত। স্ত্রীর সঙ্গে সংসার ভেঙে গেছে। মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত। গ্যালন-গ্যালন মদ গিলেছেন। আবার মনোবিদের চিকিৎসা চলছে। অবসাদ ভুলতে নাচগান আর পার্টিতে হইহুল্লোড় করে বেড়াচ্ছেন। ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিদ জেমস চ্যাডউইক পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতরকার তৃতীয় কণাটি আবিষ্কার করলেন। অনেকে ভাবলেন, এই নতুন কণাই বোধ হয় পাউলির ধারণা করা নিউট্রিনো। কিন্তু পাউলির হিসাবের চেয়ে এই কণার ভর অনেক বেশি, প্রায় প্রোটনের সমান। সেটার নাম দেওয়া হলো নিউট্রন। শিগগিরই জানা গেল সদ্য আবিষ্কৃত নিউট্রন থেকেই মূলত বেটা রশ্মির ক্ষয় হয়। ফলে জন্ম হয় একটা ইলেকট্রন ও অজ্ঞাত একটি কণার। সঙ্গে একটা প্রোটনের জন্ম হয়। ওটা রয়ে যায় নিউক্লিয়াসের ভেতরে। ফলে ট্রিটিয়ামের নিউক্লিয়াস পরিণত হয় হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে। সে বছরই ইতালিতে এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনের আয়োজন করলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি। পাউলি গেলেন সেখানে। আলোচনা করলেন ফার্মির সঙ্গে নতুন কণাটির বিষয়ে। পাউলির কথার গুরুত্ব বুঝলেন ফার্মি। তবে অজ্ঞাত কণাটির নাম ‘নিউট্রিনো’ পাউলিই রাখলেন, এর অর্থ ‘ছোট নিউট্রন’। ওই বছরই ফার্মি নিউট্রিনো নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করলেন। বেটা ক্ষয়ের সমস্যা সমাধানে নতুন একধরনের বলের প্রস্তাব করলেন ফার্মি। দুর্বল নিউক্লীয় বল। ফার্মি বললেন, এই দুর্বল বলের কারণে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ভাঙন ধরছে। নিউক্লিয়াসের একটি নিউট্রন ভেঙে একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রন তৈরি হচ্ছে। আর তৈরি হচ্ছে সেই রহস্যময় কণা নিউট্রিনো। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কণাটি নিউট্রিনো নয়, অ্যান্টি-নিউট্রিনো। অর্থাৎ পাউলি যেটাকে নিউট্রিনো মনে করতেন, সেটা আসলে অ্যান্টি-নিউট্রিনো। কিন্তু এই কণা পাওয়া যাবে কীভাবে। কোনো বাধাই এর কাছে বাধা নয়। তাই এই কণার আরেক নাম হলো ঘোস্ট পার্টিকেল বা ভূতুড়ে কণা। যে কণা স্বাচ্ছন্দ্যে সবকিছু ভেদ করে চলে যেতে পারে, সে আছে না নেই, তার প্রমাণই-বা কীভাবে হবে? অনেকেই চেষ্টা করলেন পাউলি-ফার্মির তত্ত্ব ধরে এগোতে। কিন্তু নিউট্রিনো কণার হদিস দিতে পারলেন না কেউই। দুই জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী হ্যানস বেথে ও রুডলফ পিয়ের্লেস হিসাব করে দেখান, প্রতি এক হাজার আলোকবর্ষ পুরু কোনো বস্তু ভেদ করার সময় একটি অ্যান্টি-নিউট্রিনোর সঙ্গে প্রোটনের সংঘর্ষ ঘটতে পারে। আলোকবর্ষ হলো এক বছরে আলো যতটুকু যায়, সেই পরিমাণ দূরত্ব! বেথে আর পিয়ার্লেসের হিসাব শুনে পাউলি ঠাট্টা করে ধরে বসলেন বাজি। নিউট্রিনো (অথবা প্রতি-নিউট্রিনো) যিনি আবিষ্কার করবেন, তাঁকে এক কেস শ্যাম্পেনের বোতল উপহার দেবেন পাউলি। ১৯৪০ সাল। মার্কিন পারমাণবিক গবেষণাগারে কাজ করেন ফ্রেডেরিক রেইনস। তাঁর মাথায় এনো নিউট্রিনো ধরার আইডিয়া। একদিন তিনি আইডিয়ার কথা জানালেন বন্ধু ক্লাইড কাওয়ানকে। ১৯৫৬ সালে রেইনস ও কাওয়ান ঘোষণা দিলেন তাঁরা অ্যান্টি-নিউট্রিনোর সন্ধান পেয়েছেন। পাউলি তখন আনন্দে আত্মহারা। ২৬ বছর পর তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর প্রমাণ মিলেছে! সে রাতেই বন্ধুদের নিয়ে এক কেস শ্যাম্পেন সাবাড় করলেন পাউলি। এভাবেই আবিষ্কার করা হলো ভূতুড়ে কণা নিউট্রিনো। সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট

alo
alo