ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার জন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে দায়ী করেছেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। তার ভাষায়, এটা ‘দিবালোকের মত স্পষ্ট’। হরতাল-অবরোধের মধ্যে নাশকতার বিভিন্ন ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাতে পুলিশ কমিশনার বলেছেন, “এসব তাদের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত। বিদেশি নেতাদের নির্দেশে তাদের দেশীয় এজেন্টরা এসব কাজ করছে।” মঙ্গলবার বিএনপির ডাকা হরতালের ভোরে রাজধানীতে আন্তঃনগর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় হতাহতদের খোঁজ নিতে এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ভোর ৫টার দিকে ট্রেনটি বিমানবন্দর রেলস্টেশন অতিক্রম করার পর কাকলীর কাছাকাছি এলে ‘জ’ বগির যাত্রীরা আগুন দেখতে পান। হুড়োহুড়ি করে তারা কেউ জানালা দিয়ে, কেউ দরজা দিয়ে নেমে যান। আগুনে ট্রেনটির তিনটি বগি ভস্মিভূত হয়। একটি বগি থেকে উদ্ধার করা হয় এক মা, তার শিশু সন্তানসহ চারজনের লাশ। নিহতদের মধ্যে নাদিরা আক্তার পপি ও তার তিন বছরের সন্তান ইয়াসিনকে শনাক্ত করা গেছে। বাকি দুজনকে এখনো শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশ কমিশনার বলেন, “শনাক্তকরণের জন্য তাদের আঙ্গুলের ছাপ নেওয়া যাচ্ছে না, কারণ বীভৎস নৃশংস ভাবে পুড়িয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে। তাদের শনাক্ত করার জন্য ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে।” মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে কীভাবে আগুন লাগানো হল, সে বিষয়ে কমিশনার বলেন, একজন আহত ব্যক্তি জানিয়েছেন, নাশকতাকারীরা ট্রেনের ভেতরেই ছিল। “তিনি দেখেছেন ট্রেনের আসনে প্রথমে আগুন দেওয়া হয়েছে। সেই আগুন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেছে। ধোঁয়ায় চারিদিকে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল তখন। যে যেদিকে পারে তখন দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু হয়েছে। কেউ জানালা দিয়ে কেউ দরজা দিয়ে লাফ দিয়ে পড়েছে। যেহেতু ভোরবেলা, তখন অনেকে যাত্রীই ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন।” পুলিশ কমিশনার বলেন, “যাত্রী নাদিরা আক্তার পপি তার তিন বছরের শিশুসন্তান ইয়াসিনকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় পুড়ে মারা গেছেন। হয়ত তারা বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন। সন্তান হয়ত মাকে ধরে বাঁচার চেষ্টা করেছিল, মা হয়তো সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেই আগুনে তাদের নির্মমভাবে পুড়ে মরতে হয়েছে।” শনাক্ত হওয়া লাশ দুটি পোস্টমর্টেম ছাড়াই পরিবারের কাছে দেওয়া হবে জানিয়ে কমিশনার বলেন, এ বিষয়ে রেলওয়ে থানায় মামলা হবে। ঘটনার পর রেল পুলিশের ঢাকা অঞ্চলের সুপার আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন দেওয়ার ঘটনাকে তারা ‘রাজনৈতিক নাশকতা’ হিসেবেই সন্দেহ করছেন। এর কয়েক ঘণ্টা পর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা এক বিবৃতিতে ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে ‘মানবতাবিরোধী কাজ’ আখ্যা দিয়ে ‘নিরপেক্ষ’ বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, “মহল বিশেষের প্রশ্রয় ব্যতিরেকে এ ধরনের মানবতাবিরোধী কাজ করা সম্ভব নয়। মূলত, চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে জনদৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে এটি কূটচাল কিনা, তা নিয়ে জনগণের মধ্যে গভীর সংশয় দেখা দিয়েছে। এটি সুপরিকল্পিত নাশকতার ঘটনা।” তবে ট্রেনে আগুনসহ সাম্প্রতিক নাশকতার ঘটনাগুলোর জন্য সরাসরি বিএনপিকেই দায়ী করছেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, “আপনারা জানেন একটি রাজনৈতিক দলের লোকজন কিছুদিন ধরে হরতাল ও অবরোধের নামে জনগণের জীবন ও সম্পদ ধ্বংস করে চলেছে। মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের আগুন সেই প্রক্রিয়ারই একটি অংশ বলে প্রাথমিকভাবে পুলিশ মনে করছে।” আপনি সুস্পষ্ট ভাষায় কাকে দায়ী করতে চান– সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে কমিশনার বলেন, “আমি অবশ্যই বলতে চাই যারা হরতাল করছে, অবরোধ করছে তারাই এটি করেছে। এর আগেও তারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছিল, ধরাও পড়েছে। গাজীপুরে ট্রেনের লাইন কেটে ফেলেছিল। সেখানে এই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসকে দুর্ঘটনায় ফেলে আমি বলব একজনকে হত্যা করা হয়েছিল। “এরকম যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলোর প্রত্যেকটিকে আমি সরাসরি হত্যা বলতে চাই। যারা যারা করেছে, তারা হরতাল ও অবরোধকারীদের একটি অংশ বলে আমি মনে করি। কেবল একটি অংশ নয়, এটি কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের অংশ, তাদের যারা অনুসারী আছে, তাদের যারা লেলিয়ে দেওয়া লোক আছে, তারাই এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে পুলিশ মনে করে।” কমিশনার বলেন, “এর আগে যতগুলো নাশকতা হয়েছে সবগুলোতেই আমরা নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তার করেছি। তারা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে, তাদের রাজনীতি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তারা এসব কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশিরভাগই জেলে আছেন, তাহলে এই নাশকতার নির্দেশ কারাগার থেকে আসছে, না অন্য কোথাও থেকে– এমন প্রশ্ন করেন একজন সাংবাদিক। উত্তরে কমিশনার বলেন, “বিদেশি নেতাদের নির্দেশে, তাদের দেশীয় যে এজেন্ট বা অনুসারীরা রয়েছে তাদের দিয়ে এই কাজগুলো করানো হচ্ছে, এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট।” ট্রেন যারা এ নাশকতা করেছে তাদের শনাক্ত করার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ, সিআইডি, পিবিআই, রেল পুলিশ সবাই একযোগে কাজ করছে বলে জানান হাবিবুর রহমান। রেল পুলিশ তাদের দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেছে কিনা– এ প্রশ্নে কমিশনার কোনো জবাব দেননি। নাশকতা ঠেকাতে নানা তৎপরতার মাঝেও কীভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে জানতে চাইলে কমিশনার বলেন, “অবশ্যই আমাদের তৎপরতা ছিল তারপরও ঘটনা ঘটে গেছে। এরপর যেন প্রত্যেকটি বগিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে সে বিষয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিচ্ছে, আমাদের পুলিশসহ সকল বিভাগ বিশেষ সতর্ক ও তৎপর রয়েছে।”