Kidney disease
অনলাইন ডেস্ক প্রকাশিত: ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ০৯:৪০ এএম
ঢাকার বাসিন্দা মোসাম্মৎ শামসুন্নাহার তিন বছর হলো কিডনি রোগে ভুগছেন। তিনি বলছিলেন, একদম হঠাৎ করে জানতে পেরেছেন তিনি ক্রনিক কিডনি ডিজিজে আক্রান্ত। অর্থাৎ তার দুটি কিডনির একটিও পুরোপুরি সুস্থ নেই।
কিভাবে জানলেন সে সম্পর্কে বলছিলেন তিনি, "বছরে কয়েকবার কাশি হতো সাথে জ্বর। নিয়মিত একজন ডাক্তারের কাছে যেতাম। নির্দিষ্ট দুটো ঔষধই দিত। খেলে তারপর ভাল হয়ে যেত। একবার একটা অ্যাপের মাধ্যমে বাসায় ডাক্তার ডাকলাম। উনি কয়েকটা ব্লাড টেস্ট দিয়েছিলেন। তাতে রক্তে একটা জিনিস বেশি দেখে জানালো আপনারতো কিডনি আক্রান্ত। কোন লক্ষণ নেই, কিছু না, হঠাৎ জানলাম আমার দুটো কিডনিই নষ্ট। তবে খুব খারাপের দিকে না।
এরপর থেকে দিনে আট ধরনের ঔষধ খেতে হচ্ছে তাকে। নানা বিধিনিষেধ এবং ঔষধে সমস্যাটি যে পর্যায়ে ছিল সেই পর্যায়েই ধরে রেখেছেন। কিন্তু কিছু লক্ষণ তিনি আগে ধরতে পারলে হয়ত আরও আগেই জানতেন।
"যখন ধরা পড়লো তার বছর কয়েক আগে মাঝে মাঝে পা ফুলে যেত। কোন গুরুত্ব দেইনি। ডাক্তার যখন জিজ্ঞেস করেছিল পা ফুলেছিল কি না কখনো তখন মনে পড়েছিল।
বাংলাদেশে অনেকেই এরকম হঠাৎ করেই জানতে পারেন কিডনি সমস্যার কথা। কিন্তু শুধু ত্বকের সমস্যা থেকে মোঃ মিজানুর রহমান জেনেছিলেন তার ছোট ভাইয়ের দুটি কিডনির একটি আকারে ছোট।
কিডনি'র অসুখে চোখের নিচে, পায়ের গোড়ালিতে পানি জমে।
তিনি বলছিলেন, "সপ্তম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় হঠাৎ ওর সারা শরীরে খুব চুলকানি হয়েছিল, ফুসকুড়ির মতো। তখন আমি ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা দিয়েছিলো। সেগুলো দেখে ডাক্তার বলেছিল যে ওর একটা কিডনি আকারে ছোট। নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে হবে, তাহলে ভাল থাকা যাবে। পরে ঔষধে চুলকানি সেরে গেল। তারপর বছর দশেক আর ডাক্তারই দেখানো হয়নি।
দুই বছর আগে দুটো কিডনি বিকল হয়ে মারা গেছেন তার ছোট ভাই।
পেশায় গাড়িচালক মোঃ মিজানুর রহমান বলছিলেন, "এক পর্যায়ে বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন ও নিজে বুঝতে পারলো যে সমস্যা হচ্ছে, তখন সে একজন ভেষজ ডাক্তারের কাছে যাওয়া শুরু করলো। তাতে কোন লাভ তো হলোই না বরং ও খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। একদম রক্ত কমে গিয়েছিল। এইরকম অবস্থায় ওকে ঢাকায় যখন কিডনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ততদিনে ওর দুটো কিডনি পুরো বিকল। ডাক্তার বলেছিল প্রতিস্থাপন ছাড়া কোন উপায় নেই।
এরপর ডায়ালাইসিস করিয়ে ধুকে ধুকে কয়েকমাস বেঁচে ছিলেন। প্রতিস্থাপনের জন্য কিডনি পাওয়া যায়নি বলে শেষ পর্যন্ত আর বাঁচাতে পারেননি ভাইকে।
শুধুমাত্র ত্বকের একটি লক্ষণের মাধ্যমে জানা গিয়েছিলো কিডনির সমস্যা। এরকম আরও কিছু লক্ষণ রয়েছে যার মাধ্যমে একজন সাধারণ মানুষ সন্দেহ করতে পারেন যে হয়ত এটি কিডনি'র কোন সমস্যা হতে পারে।
কারণ ছাড়াই সবসময় ক্লান্তিভাব হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ঢাকায় অবস্থিত জাতীয় কিডনি ইন্সটিটিউট এবং হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজল নাসের বলছেন, একদম প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনির অসুখের তেমন কোন লক্ষণ থাকে না। কারণ শরীর কিডনি'র পরিবর্তনের সাথে শুরুতে মানিয়ে নিতে পারে।
লক্ষণ দেখা দেয় প্রাথমিক পর্যায় পার হলে। তিনি বলছেন, বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে যা একজন সাধারণ মানুষেরও খালি চোখে নজরে পড়ে। যা দেখে তিনি সাবধান হতে পারেন।
কোন নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই সবসময় ক্লান্তি, দুর্বল অনুভব করা, ওজন কমে যাওয়া এরকম যদি নিয়মিত হতে থাকে। কিডনি ঠিক মতো কাজ না করলে রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয় সে কারণে এই ক্লান্তিভাব হয়।
বিশেষ করে চোখের নিচে, পায়ের গোড়ালি ও হাতে ফোলা ভাব। ডা. নাসের বলছেন, একটু বেশি ঘুমালে বা অ্যালার্জির কারণে ফুলে যাওয়ার সাথে কিডনির অসুখে ফোলার পার্থক্য হচ্ছে এর স্থায়িত্ব।
"যদি চোখের নিচে, পায়ের গোড়ালি ফোলাভাব স্থায়ী হয়, এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ হয় তাহলে সেটা কিডনি'র কারণে হতে পারে।"
কিডনি যখন শরীর থেকে পানি বের করতে পারে না তখন তা শরীরে জমে গিয়ে এই ফোলাভাব হয়।
কিডনি'র অসুখে বলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
এটিও কিডনি সমস্যার একটি লক্ষণ হতে পারে। কিডনি যখন শরীর থেকে পানি নিঃসরণ করতে পারে না তখন কিছু পানি ফুসফুসে জমে যায়। সে কারণে ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
"দাঁড়ানো অবস্থায় বুক ভরে শ্বাস নেয়া যায় কিন্তু দেখা যায় শোয়া অবস্থায় বুক পুরোপুরি প্রসারিত হতে পারে না। পানি জমলে সমস্যাটা বেশি হয়। ঘুমন্ত অবস্থায় শ্বাসে সমস্যা হয় বলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।
কিডনির একটি কাজ হল শরীর থেকে সব ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেওয়া। কিডনি সেই কাজটি ঠিকমতো করতে না পারলে ত্বকে এর ছাপ পড়ে।
যেমন শরীরের ইউরিয়া বের হতে না পেরে ত্বকের নিচে জমা হতে থাকে। তখন চুলকানি হয়, ত্বকের রঙ পরিবর্তন ও খসখসে হয়ে যেতে পারে, ফুসকুড়ি হতে পারে।
ডা. নাসের বলছেন, "প্রাথমিকভাবে অনেকে এটিকে চর্মরোগ মনে করতে পারেন। সেটি মনে করেও যদি একজন চিকিৎসকের কাছে যান তাহলেও একটা ক্লু পাওয়া যেতে পারে।
কিডনি ঠিকমতো কাজ করতে না পারলে ত্বকে এর ছাপ পড়ে।
ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া অথবা প্রস্রাব কমে যাওয়া দুটোই কিডনির সমস্যার লক্ষণ। শরীর থেকে পানি বের করা ছাড়াও পানি শুষে নেয়ার কাজও করে কিডনি। সেটি করতে না পারলে বেশি প্রস্রাব হয়ে থাকে।
প্রস্রাবের রঙ লালচে হলে, প্রস্রাবে ফেনা ভাব হলে। কিডনিতে পাথর, ক্যান্সার, টিউমারের কারণে প্রস্রাবের সাথে রক্ত যেতে পারে। কিডনি'র সমস্যা হলে শরীর থেকে প্রোটিন বেশি বের হয়ে যায় তাই ফেনা ভাব হয়।
কিডনি'র সমস্যার কারণে ইলেক্ট্রোলাইট, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের ভারসাম্যহীনতা হয়ে থাকে। এতে মাংসপেশিতে টান লাগা ও খিচুনির সমস্যা হতে পারে। এছাড়া খাবারে দীর্ঘদিন অরুচি ও বমিভাব এগুলোই কিডনি অসুখের প্রধান লক্ষণ।
"এর একটি লক্ষণ থাকলেও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ। তবে ধরেই নেবার প্রয়োজন নেই যে কিডনি'র সমস্যাই হয়েছে। কিন্তু সাবধান হতে ক্ষতি নেই", বলছিলেন ডা. নাসের।
তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন এসব লক্ষণ চোখে পড়লে শুরুতে একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ দেখানো উচিৎ।
ব্যথানাশক ঔষধ এড়িয়ে চলুন।
কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে কিডনির সমস্যা থেকে দুরে থাকা যায়। এ নিয়ে ডা. ফজল নাসের কয়েকটি পরামর্শ দিচ্ছেন:
দুটি অসুখকে কিডনির বড় শত্রু বলা হয়। একটি হল উচ্চ রক্তচাপ অন্যটি ডায়াবেটিস, এই দুটি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরী। বেশি দিন ধরে ইউরিন ইনফেকশন, কিডনিতে পাথর ও প্রস্টেটের সমস্যা কিডনির ক্ষতি করে। তাই এই অসুখগুলো পুষে রাখবেন না।
ব্যথানাশক ঔষধকে বলা হয় কিডনির জন্য বিষ। ইচ্ছেমত মুড়িমুড়কির মতো ব্যথানাশক ঔষধ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। কিছু অ্যান্টিবায়োটিকস চিকিৎসকে পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিৎ নয়।
শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভিটামিন সি কিডনির ক্ষতি করে।
যেসব খাবারে অতিরিক্ত ভিটামিন সি রয়েছে সেগুলা না খাওয়া অথবা পরিমিত খাওয়া। "খুব বেশি কামরাঙ্গা খেলে, যেমন এক গ্লাস কামরাঙ্গার জ্যুস খেলে এমনকি একটি সুস্থ কিডনি নষ্ট করে দিতে পারে। কিছু দেশে কামরাঙ্গা চাষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ", বলছিলেন ডা. ফজল নাসের।
অনেক ভিটামিন সি রয়েছে বলে অতিরিক্ত আমলকী খাওয়ারও ক্ষতি রয়েছে। তবে ফল হিসেবে ছোট ও অনেকের কাছে এটি বিস্বাদ মনে হয় বলে এটি খাওয়ার প্রবণতা কম। এছাড়া নিয়মিত শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভিটামিন সি খাওয়া, বিশেষ করে অতিরিক্ত 'সাপ্লিমেন্ট' কিডনি'র ক্ষতি করে।
ডা. নাসের উদাহরণ দিয়ে বলছেন, "এমনও দেখেছি যে বাচ্চাকে চুষে খাওয়ার ভিটামিন সি কিনে দেয় নিয়মিত। সারাক্ষণ খেতে থাকে। এরকম অতিরিক্ত ভিটামিন সি খেলে কিডনি'র ক্ষতি হয়। দিনে সর্বোচ্চ ৮০ থেকে ৯০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, অর্থাৎ একটা কমলা, এই পর্যন্তই ঠিক আছে।
এছাড়া লবণাক্ত খাবার, ধূমপান, অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন।
বিনা পারিশ্রমিকে হাজারের বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন যে চিকিৎসক
সূত্র: বিবিসি বাংলা