Parliament election
শাহানুর রহমান রানা প্রকাশিত: ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ০৯:৩৬ এএম
নির্বাচন কমিশনের ঘোষণানুযায়ী আগামী বছরের ৭ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অন্যান্য স্থানের মতো নানা জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে রাজশাহী-২ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য ও সিনিয়র নেতা শফিকুর রহমান বাদশা লড়বেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে। আর অন্যদিকে, ১৪দলীয় জোটের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনের মাঠে জয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ফজলে হোসেন বাদশা। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশার প্রতীক নৌকা। আর অন্যদিকে, মহানগর আ’লীগের সহসভাপতি শফিকুর রহমান বাদশা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়বেন কাচি প্রতীক নিয়ে। আসনটির জন্য নির্বাচন মাঠে ভোটযুদ্ধ করবে আরো পাঁচদলের প্রার্থী। জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বিএনএম, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, জাসদ। মোট সাতজন প্রার্থী নিয়ে সদর আসনে জমে উঠবে ভোটের লড়াই বলে মন্তব্য নেতাকর্মী ও সমর্থকদের।
উল্লেখ্য, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ রাজশাহীর ৬ টি আসনের মধ্যে ৫ টিতেই বিজয় লাভ করেছিল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। কিন্তু এবার রাজশাহী সদর আসনে ১৪দলের অন্যতম শরীকদল ওয়ার্কার্স পার্টির সেক্রেটারি (কেন্দ্রীয়) ফজলে হোসেন বাদশা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলেও নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নেমেছেন ভোটের মাঠে। এতে করে নগর আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠণ ও সহোযোগি দলগুলোর নেতাকর্মীদের মতো সাধারণ সমর্থকরা অনেকটাই দ্বিধাদ্বন্দ্বের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য তাদের। কাকে দেবো ভোট? প্রার্থী, দল নাকি প্রতীকে। যিনি নগরবাসির সার্বিক বিষয়ে পজিটিভ ভাবে পাশে থাকবেন তাকেই চায় নগরবাসি বলে মন্তব্য বিভিন্ন এলাকার সচেতন ব্যক্তিরা। পাশাপাশি আরো একটি উক্তি করে বসেন অনেকেই। দুই বাদশার কাউকেই তেমনভাবে কখনোই কাছে পাননি নগরীর অধিকাংশ ওয়ার্ড ও মহল্লাবাসি ! তাই দ্বিধাদ্বন্দ্ব শুধু রাজনৈতিক অবস্থান, দলীয় প্রতীক কিংবা নামের মিল অমিলের বিষয়েই আবদ্ধ নয়। তৃণমূল বাসিন্দাদের সাথে নিয়মিত সম্পৃক্তার অভাবে সাধারণ ভোটাররা একজনকে চিনলেও; অনেকেই চেনেন না আরেকজনকে।
নগরবাসির ধারণা, এই আসনটিতে এবার দুই বাদশার লড়াই হবে সমানে সমানে। কিন্তু, জটিল কিছু সমীকরণ শেষে ফলাফল কার দিকে যাবে সেটা বলা অনেকটাই কঠিণ। ফজলে হোসেনের সমর্থকরা বলছেন, বর্তমান সরকারের দলীয় প্রতীক নৌকা দেখে ভোটাররা ওয়ার্কাস পার্টির সেক্রেটারি ও ১৪দলীয় জোটের প্রার্থী বাদশাকে ভোট দেবেন। আর অন্যদিকে, শফিকুর রহমান বাদশার সমর্থকরা বলছেন, তিনি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা হওয়ায় দলটির কর্মী-সমর্থকরা অধ্যক্ষ বাদশা স্যারকে ভোট দেবেন। দলের নেতা আর দলীয় প্রতীকের মধ্যে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করবে তৃণমূল নেতাকর্মী, সমর্থক আর সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বলে মন্তব্য ভোটের মাঠে কাজ করা নেতাকর্মী ও সমর্থকদের। বিষয়টি বেশ জটিল সমীকরণের মধ্যদিয়েই ইতি টানবে বলেই ধারণা অনেকের।
এদিকে, সদর আসনের সর্বোচ্চ হেভিওয়েট এই দুই প্রার্থীর উভয়ের ডাকনাম ‘বাদশা’। যার কারণে প্রথমেই সাধারণ ভোটাররা হোঁচট খাচ্ছে প্রার্থীর নাম শুনে। প্রচার মাইকিং থেকে ভেঁসে আসা শব্দের একাংশে এসে বাদশা নামটি ভেঁসে আসে অতিসহসায়। কারণ, প্রতিকের চাইতে ব্যক্তির বিষয়টিই আগে প্রাধান্য পাবে ভোটারদের কাছে বলে মন্তব্য সাধারণের। যার কারণে কে কোন প্রতীক সেটি কখনো কখনো অস্পষ্টই থেকে যাচ্ছে সাধারণ ভোটারদের কাছে। এখানেও জটিলতার স্পর্শ।
মন্তব্য করতে গিয়ে অনেকেই বলেন, নির্বাচনে জয় পরাজয় নির্ভর করে প্রতীক কিংবা দলীয় প্রভাবের কারণে নয়। বেশকিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে জয় পরাজয়ের বিষয়টি। এরমধ্যে অন্যতম হলো, প্রার্থীর যোগ্যতা, দল ও দশের জন্য বিশেষ অবদান রাখা, স্থানীয় রাজনীতির প্রসার ঘটাতে নিয়মিত ভূমিকা, সকল শ্রেণি ও পেশাজীবি মানুষের সাথে বছরজুড়ে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা, নিজস্ব ভোট ব্যাংক বৃদ্ধিকরণসহ আরো বেশকিছু বিষয়। উভয় প্রার্থীর ক্ষেত্রে এখানেও রয়েছে কঠিণ একটি হিসেব নিকেষ। এবার যারা প্রথমবারের মতো ভোটার হলো তারাও বড় একটা ফ্যাক্ট উভয় প্রার্থীর জন্য। এছাড়াও যেসকল ভোটারদের ওপর বিএনপি কিংবা অন্যকোন দলের তেমন কোনো প্রভাব নেই তারাও একটা বড় ফ্যাক্টর ভোটের সমীকরণ মেলানোর ক্ষেত্রে বলে মন্তব্য স্থানীয় ভোটারদের।
আ’লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ ও ছাত্রলীগ ছাড়াও অন্যান্য অঙ্গসংগঠণের বড় একটি অংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভোট সংগ্রহে কাজ করছে কাঁচি প্রতীকের প্রার্থী বাদশার জন্য। আর অন্যদিকে, ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা ও ১৪দল সমর্থিত নৌকা প্রতীকের কান্ডারি বাদশার ভোট ব্যাংক নিশ্চিত বল্পে মাঠে কাজ করছে তার নিজস্ব দলের নেতাকর্মীরা। এছাড়াও কাজ করছে মহানগর আওয়ামী লীগের একাংশ বলে জানান নেতাকর্মীরা। সরেজমিনে তার সত্যতাও পাওয়া গেছে। জয় পরাজয়ের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোকেও বড় একটি ফ্যাক্টর বলে দাবি কর্মী-সমর্থকদের।
নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী শফিকুর রহমান বাদশার সমর্থকরা। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী থাকতে কেঁচি প্রতীকে কেনো ভোট দেবেন প্রশ্নের জবাবে সমর্থকরা বলেন, গত ১৫ বছর ১৪দলীয় জোটের প্রার্থী রাজশাহী সদর আসনে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কার্যত কোনো সম্পর্ক ছিল না। উন্নয়নের ক্ষেত্রে মেয়রের সঙ্গেও স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাজের তেমন কোন সমন্বয় পাওয়া যায়নি। সমর্থকদের বিশ্বাস, দলের নেতাকর্মীর অধিকাংশ ভোট এবার শফিকুর রহমান বাদশার ঘরেই আসবে।
অন্যদিকে, ফজলে হোসেন বাদশার সমর্থকরা বলছেন, সাধারণ ভোটাররা নৌকা প্রতীকেই ভোট দেবেন। এছাড়াও বাদশার প্লাস পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে নগর আ’লীগের নেতাকর্মীসহ তাঁর নিজদলীয় নেতাকর্মীদের ভোটগুলো। এছাড়াও তিনি কয়েক ট্রাম ছিলেন সদর আসনের এমপি। তাই এবিষয়টিও ভোট ব্যাংক বৃদ্ধির জন্য কাজ করবে।
বিগত সময়ের নির্বাচনী ফলাফল খুব একটা সহায়ক হিসেবে কাজ করবে না নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশার জন্য। অন্যদিকে, স্বতন্ত্র প্রার্থী নগর আ’লীগ নেতা শফিকুর রহমান বাদশাকে দলের নেকাকর্মী ব্যতীত নগরীর সাধারণ ভোটারদের অধিকাংশই তেমনভাবে চেনেনা। যার কারণে, চরম দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোটাররা।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধীদলগুলি নির্বাচন বর্জন করে তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নিলে ফজলে হোসেন বাদশা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন। এর আগে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ফজলে হোসেন বাদশা নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোটযুদ্ধে পরাজিত করেছিল বিএনপি’র প্রাথী মিজানুর রহমান মিনুকে। ঐ নির্বাচনে বাদশা পেয়েছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৯ ভোট। আর মিজানুর রহমান মিনু পেয়েছিল ৮৯ হাজার ৫০ ভোট। এর আগের ২০০১ সালের নির্বাচনে ফজলে হোসেন বাদশা নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে ভোট প্রাপ্তির দিক দিয়ে স্থান পান তৃতীয়তে। মিজানুর রহমান মিনু ঐ নির্বাচনে ভোট পান ১ লাখ৭৬ হাজার ৪০৫ টি। আর অন্যদিকে ফজলে হোসেন বাদশা ১১,৪৯০ টি ভোট পেয়ে তৃতীয়স্থান লাভ করেন। অন্যদিকে ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন ৯৬ হাজার ৬০৪ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন। ফজলে হোসেন বাদশা ঐ নির্বাচনে মোট কাস্টিং ভোটের মধ্যে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ (৩.৯%) ভোট পেয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে রাজশাহী সদর আসন থেকে ফজলে হোসেন বাদশা ভোটযুদ্ধে অর্জন করেছিলেন পঞ্চম স্থান। মোট ভোট পেয়েছিলেন ৩,৮৩৮ টি। ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটনের ঝুড়িতে পড়েছিল ৭৫ হাজার ৮০৩ টি ভোট। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ (ইউসিএল) দল থেকে ফজলে হোসেন বাদশা নির্বাচন করে ভোট পান ৩৪,২৬৭ টি। অন্যদিকে, বিএনপি’র প্রার্থী কবির হোসেনের ভোট সংখ্যা ছিল ৮১ হাজার ১৪টি। সেবারেও ফজলে হোসেন বাদশার স্থান ছিল তৃতীয়।