আর্কাইভ কনভাটার ঢাকা, বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
logo

বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদের কথা


ওয়ালিউর রহমান বাবু প্রকাশিত:  ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ০৯:৫৭ এএম

বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদের কথা

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ মাকফোর উদ্দিন চৌধুরী আজাদ ঢাকার উচ্চবিত্বশালী পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাদের ঢাকার নিউ স্কাটনের বাড়িটি রাজপ্রাসাদের মতন কিন্তু তার ও তার মায়ের মানসিকতা ছিল অন্য রকম। বাড়ির দারুচিনি গাছের গন্ধে পরিবেশটা থাকত সবসময় অন্যরকম। পুকুরটিতে রাজহাস সাতার কাটত। মা সাফিয়া বেগম বাবা ইউনুস আহমেদ চৌধুরী। আজাদের বাবা আরেকটি বিয়ে করলে আজাদের মা আজাদকে নিয়ে  বাড়ি ছেড়ে অন্য একটি বাড়িতে চলে যান। জানা যায় আজাদ অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং মেধাবী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা অর্জন করেন। তার বন্ধুরাও অত্যন্ত মেধা সম্পন্ন ছিলেন। বিত্তশালী পরিবারের সন্তান হয়েও আজাদ আন্দোলন সংগ্রামের কর্মসূচিতে অংশ নিতেন।

জানা যায় ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রক্টোর ড. সামসুজ্জহা হত্যা হলে এর প্রতিবাদে আজাদ ঢাকার কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বাড়ি ফিরে মাকে গিয়ে বলেন “ইয়াহিয়া খান আজ শেষ। আজ তার কুলখানি” মা তাকে মিছিলে যেতে নিষেধ করলেও তাকে কখন থামানো যায়নি। আজাদের বাবা তাকে তার মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে করাচিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলে তার মা প্রথমে রাজি হননি। পরবর্তিতে স্বজনদের পরামর্শে রাজি হন। আজাদ করাচিতে গিয়ে নানা বিষয়ে মাকে চিঠি লিখতেন। করাচি থেকে পড়া শেষে ফিরে এলে মা তাকে বাবা ও অন্যান্যদের সাথে দেখা করতে বলেন কারণ এটি ছিল তার ও তার মায়ের লড়ায়ের বিজয়। ঢাকা শহরের কথায় কি হচ্ছে বাড়ি ফিরে এসে মাকে জানাতেন। বলতেন মা রাস্তায় যাওয়ার লোকজন চলতে চলতে মিছিল করেছে, রাস্তার ধারে দাড়িয়ে থাকা লোকজন মিছিল করেছে। পহেলা মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা চলছিল। সে ক্রিকেটার জুয়েল ও অন্যান্য বন্ধুদের সাথে খেলা দেখছিলেন। পাকিস্তান সরকারের সংসদ স্থগিতের ঘোষণায় ঢাকা স্টেডিয়াম উত্তাল হয়ে ওঠে। তিনি তখন বন্ধুদের নিয়ে গ্যালারি থেকে স্লোগান দিতে থাকে। সেখান থেকে বেড়িয়ে মিছিল করে হোটেল পুরবানির সামনে উপস্থিত হন। সে সময় সেখানে চলছিল আওয়ামী লীগের জরুরী সভা।

শুরু হয়ে গেল স্বাধীনতার সংগ্রাম। আজাদ এসব নিয়ে বন্ধুদের সাথে এগুলি নিয়ে আলোচনা করতে থাকেন ২৫শে মার্চ ঘটনা তাকেও প্রভাবিত করলেও তিনি ভয় পাননি। এলো মুক্তিযুদ্ধের ডাক। কিন্তু তিনি জাননেন না তার বন্ধুরা সীমান্তের ওপারে ট্রেনিং নিতে গেছে। পাকিস্তানী পন্থীরা তাদের বাড়ির দিকে নজরদারি করছে এখবর পেয়েও আজাদ পিছ পা হয়নি। একদিন ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবের সামনে তার দেখা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামালের সাথে। তাকে দেখে আজাদ নাম ধরে ডাকতে থাকলে কাজী কামাল তাকে চুপ করতে বলে একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকেন। তার কাছ থেকে আজাদ জানতে পারেন বন্ধুরা ট্রেনিং নিয়ে এসছে। আজাদ রাগ করে বলে কেন তাকে ছেড়ে তারা ট্রেনিং এ গেছেন। কাজী কামাল তাকে বলেন তিনি দেশের মধ্যে থেকেই কাজ করতে পারেন। তিনি অস্ত্র রাখা ও সেল্টারের জন্য সহযোগিতা চাইলে আজাদ রাগ ভুলে গিয়ে রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু কাজী কামাল তাকে বলেন মায়ের অনুমতি নিতে আজাদ বাড়ি ফিরে মাকে বিষয়টি জানালে মা অনুমতি দিলেন। আজাদ মায়ের অনুমতি পেয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামালের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে ক্র্যাক প্লাটুনের যোদ্ধা হিসেবে ভুমিকা রাখতে থাকলেন। করতে থাকলেন সফল একশন অপারেশন। ৩০ আগস্ট ধরা পরে গেলে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে ধরে ঢাকার রমনা থানার পাশে টর্চার ক্যাম্পে বন্দী করে করে নির্যাতন করতে থাকে। এদিন আজাদের ফুফাতো ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা জায়েদ গুলিবিদ্ধ হন। জানা যায় কামরুজ্জামান নামে একজনের কাছে খবর পেয়ে তার মা তার সাথে দেখা করতে গিয়ে রক্তাক্ত নির্যাতনে বিকৃত হয়ে যাওয়া তার আদরের আজাদকে প্রথমে চিনতে পারেননি। আজাদ মাকে তার উপর নির্যাতনের ঘটনা জানিয়ে বলেন পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে দুইদিন খেতে দেয়নি। সঙ্গীদের পরিচয় জানতে চেয়ে তার উপর অকাট্ট নির্যাতন করে। তার মা তাকে সাহস দিয়ে কারও পরিচয় না জানানোর কথা বলে বলেন “অত্যাচার তোমাকে সহ্য করতে হবে”। সঙ্গীদের পরিচয় একশন অপারেশনের তথ্য জানার জন্য পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে রাজ শাক্ষী করে ছেড়ে দেবার লোভ দেখায়। কিন্তু আজাদ রাজি হননি। পরের দিন আজাদের মা টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত, মুরগীর মাংস, বেগুন ভাজা, নিয়ে থানার সামনে সারারাত দাড়িয়ে থেকেও আজাদের দেখা পেলেন না।

বিজয় এল কিন্তু আজাদ আসেননি। আজাদকে না পেয়ে আজাদের মা ১৪ বছর শানের মেঝেতে শুয়ে থেকেছেন। ভাত মুখে দেননি, এক বেলা রুটি খেয়ে থেকেছেন। এরকম না জানা এরকম অসংখ্য ঘটনা আমরা কয়জন জানি। শুধু বক্তব্যের ফুলঝুরি দিয়ে আর নানা কথা বলে এদের ঋন কখনই শোধ হবে না। অন্তর থেকে সূর্য সন্তানদের ভালোবাসা দিতে হবে। প্রজন্মদের কাছে এদের বীরত্ব তুলে ধরতে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন এবং যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেছেন তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। জানা যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ মাকফোর উদ্দিন চৌধুরী আজাদ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় ৩০ আগস্ট পাকিস্তানী সৈন্যের কাছে ধরা পরেন। তার মা মারা জান ১৯৮৫ সালের ৩০ আগস্ট। মৃত্যুর আগে তিনি তার মৃত্যুর কথা কাওকে না জানাতে বললেও বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে ক্র্যাক প্লাটুনের বীর যোদ্ধা সহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ তাদের বাড়িতে আসেন। পরের দিন তারা তাকে দাফন করেন।   

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

{সংক্ষিপ্ত} [তথ্য সুত্রঃ “মা-আনিসুল হক, গ্রন্থনাঃ মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক]