স্মৃতির দর্পণে জেগে থাকা ঘটনাগুলো এখন ‘মনের মুকুরে’
শাহানুর রহমান রানা
প্রকাশিত: ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ০৫:৪১ এএম
সমগ্র জীবনের প্রতিচ্ছবি আর বাস্তব অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ একটি আত্মজীবন কাহিনী খন্দকার আমানুল ইসলাম চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন তার লিখা ‘মনের মুকুরে গ্রন্থে’। নিজের স্মৃতিতে ভাস্বর দিনগুলোর চমৎকার বর্ণনায় তুলে ধরেছেন এই গ্রন্থটিতে। পরাধীন ভারতের কিছু অস্পষ্ট স্মৃতি, নিজের কৈশোর ও যৌবনে দেখা তৎকালিন ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক হানাহানি, স্বাধীনতা যুদ্ধ, নিজের শিক্ষাজীবন, চাকুরি ও সংসার জীবনসহ স্বজন-পরিবার, ভ্রমণকাহিনী ছাড়াও স্মৃতিময় জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাতকে জয় করে অবশেষে ব্যাংকার হিসেবে চাকুরি জীবনের ইতিটানা। সবকিছুই আছে এই গ্রন্থটিতে। মানের মুকুরের আভিধানিক অর্থ হলো, মনের আয়না।
লেখক খন্দকার আমানুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে। শৈশব, কৈশোর আর যৌবন কেটেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার নবস্থা গ্রামে। ভারতবর্ষ দ্বিখন্ডিত হবার পর ঐসময়ে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় লেখকের বাবা খন্দকার আবুল মুফিত পুরো পরিবার নিয়ে চলে আসেন এবারের বাংলায় (বর্তমানে বাংলাদেশ)। বাবা আবুল মুফিত ছিলেন পেশায় একজন গ্রাম্য ডাক্তার।
গ্রন্থটিতে তিনি তুলেধরেছেন যুদ্ধকালিন সময়ে স্বপরিবার নিয়ে ভারতে আশ্রয় ও জীবনযুদ্ধ। এছাড়াও গ্রন্থটিতে তিনি সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরেছেন ভ্রমণ কাহিনী। গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে লেখকের দীর্ঘ কর্মজীবনের চলার পথে বিভিন্ন সময় হোঁচট খাওয়া অতঃপর সেগুলো সামলে নিয়ে অবশেষে চাকুরি জীবনের সমাপ্তি ঘটানো। প্রতিটি বিষয় তিনি খুব চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের মানুষদেরকে সততা আর নিষ্ঠার বিষয় সম্পর্কে দিক্ষা দেবার প্রয়াসে। ২০২৩ সালে জুলাই মাসে গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণ বের করেন তিনি। দ্বিতীয় খন্ডের কাজও প্রায় শেষের দিকে বলে জানান, মনের মুকুরে গ্রন্থটির লেখক খন্দকার আমানুল ইসলাম। প্রকাশনা উৎসবকে স্মৃতিময় করে রাখতে ফেলে আসা কর্মক্ষেত্রের পুরনো ও নতুন সতীর্থদের সাথে নিয়ে গত ২ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করেন লেখক আমানুল ইসলাম। ব্যাংকের চাকুরীজিবন শেষে অবসর সময়গুলো কাটতো ছাদবাগান পরিচর্যা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের স্মৃতিবিজরিত সত্যঘটনাগুলোকে তুলের ধরা মাধ্যমে।
চ্যানেল আই এর জনপ্রিয় সাংবাদিক শাইখ সিরাজ ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে লেখকের বাড়িতে এসেছিলেন ছাদকৃষি পরিদর্শনে। বাবার কাছ থেকে পাওয়া দিক্ষা আর অনুপ্রেরণায় লেখকের মেয়ে শামীমা খন্দকারের নিজ হাতে করা ছাদকৃষি পরিদর্শন শেষে অভিভূত হয়েছিলেন শাইখ সিরাজ বলে জানান শামীমা খন্দকার। তিনি আরো বলেন, নিজের বাড়ির সীমানা ও ছাদে বাগান করা ও প্রকৃতির প্রতি আবেগ ভালবাসার বিষয়টি আমাদের পরিবারে এসেছে জেনিটিকগত ভাবেই। ছাদকৃষি পরিদর্শনকালে সাংবাদিক শাইখ সিরাজের হাতে লেখক উপহার স্বরূপ তুলে দেন নিজের লেখা গ্রন্থ মনের মুকুরে। পরবর্তীতে সাংবাদিক শাইখ সিরাজ গ্রন্থটির ৩১৪ তম পৃষ্ঠায় লেখা সৌদি আরবের বায়তুল্লাহ শরীফ দেখার মূহুর্তকালীন আত্মতৃপ্তিমূলক লেখনি ছাড়াও আরো বেশকিছু পৃষ্ঠার লেখনির একাংশ চমৎকার উপস্থাপনার মাধ্যমে চ্যানেল আই টিভির ইউটিউব পার্টে তুলে ধরেন সাংবাদিক শাইখ সিরাজ। লেখকের লেখা গ্রন্থ মনের মুকুর নিয়ে প্রশংসাও জুড়েদেন মন্তব্যের সূরে।
লেখক আমানুল ইসলাস স্নাতক পাশ শেষে কলকাতার একটি জুতার কোম্পানিতে হিসাবরক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স ডিগ্রী) সম্পন্ন শেষে যোগদান করেন তৎকালীন হাবিব ব্যাংক লিমিটেডে। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের পর অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডে চাকুরি করেন দীর্ঘ সময় ধরে। এজিএম হিসেবে চাকুরিজীবনের ইতিটানেন ১৯৯৯ সালে। ছোটবেলা থেকেই পরিবেশ প্রকৃতি আর লিখালিখির উপর ভালবাসা আর আবেগীয় অন্তরঙ্গতা ছিল বলে জানান তিনি।
নিজের লেখা ‘মনের মুকুরে’ নামক গ্রন্থে ‘স্মৃতিপটে কাগ্রাম’ শিরোনামে বর্ণনামূলক গল্পে তিনি চমৎকার ভাবে তুলে ধরার প্রয়াস করেছেন শৈশবে একজন শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভর বিষয়টিকে। তিনি সেখানে লিখেছেন, শৈশবে পরিবেশ এবং পরিবারের আচার আচরণ থেকে একজন শিশু তার প্রথম পাঠ গ্রহন করে সকলের অলক্ষ্যেই। আমরা বড়রা যখন যে কাজই করিনা কেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মত শিশুরাও অধীর আগ্রহে তা প্রত্যক্ষ করে এবং এর প্রভাব তার শিশু মনকেও নাড়া দিয়ে যায়।
তিনি তার গ্রন্থের নাম দিয়েছেন ‘মনের মুকুরে’। যার আভিধানিক বাংলা অর্থ মনের আয়নাতে বা দর্পণে।
সাহিত্যানুরাগী ছিলাম স্কুলজীবন থেকেই। তখনই শ্রদ্ধেয় একজন শিক্ষকের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় অনুরাগ বিরাগে পরিণত হ'ল। তাই ন্যাড়ার আর বেল তলায় যাওয়া হয়নি। এর পর যখন ব্যাস্ততাহীন অবসর জীবনে পদার্পণ করলাম তখন বেহিসেবী সময় কাটাতে বই'ই হ'ল প্রধান সঙ্গী। সব ধরনের বই। কোনোকিছুই বাদ যায়নি। প্রাথমিক শিক্ষা মাদ্রাসা থেকে শুরু হওয়ায় ধর্মীয় বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল বেশী।
লেখক তার গ্রন্থে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে আকাশপথের যুদ্ধের কিছু চিত্র নিজের লেখনির মাধ্যমে চমৎকার করে তুলে ধরেছেন। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে করা সগৌরবতুল্য মন্তব্য করেন গর্বের সাথেই। তিনি তার স্মৃতিচারণ থেকে লিখেছেন, আমরা ঢাকা থেকে আকাশ যুদ্ধ দেখেছিলাম। ভারতীয় ‘মিগ-২১’ এর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি ‘ডেকোটা ফাইটার’ যুদ্ধবিমান কতখানি অসহায় ছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি মিগ-২১ এর সমনে সেগুলো তৃনখন্ডের মত উড়ে গেছে। এমন একটি ডেকোটা যুদ্ধবিমান বিদ্ধস্ত হলে পাইলট প্যারাসুটের সাহায্যে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বুড়িগঙ্গার ওপারের জনপদে অবতরণ করে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। এটা আশ্চর্যজনক বিষয় যে, স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ভারতীয় সৈন্যের সহযোগিতায় পাকিস্তানের মত পরাশক্তির কবল থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে!