কৃষকের উৎপাদন খরচ নিম্নপর্যায়ে রাখতে সরকার ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত (১৩ বছর) সার, বিদ্যুৎ, সেচসহ বিভিন্ন খাতে মোট ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়েছে। এছাড়াও সার, বীজ, কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ বিতরণে সুশাসন নিশ্চিতের পাশাপাশি কৃষি উপকরণের দাম কমানো হয়েছে এবং তা কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) সকালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ অনুষ্ঠানে কৃষি খাতে উন্নয়ন ও অগ্রগতি প্রসঙ্গে এসব তথ্য জানানো হয়।
ইশতেহারে বলা হয়, কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জনগণের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানে, শিল্পের কাঁচামাল জোগানে ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে কৃষির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে কৃষিবিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কৃষির উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
উন্নয়ন ও অগ্রগতি
> খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পর উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। বিগত ২০২২-২৩ সালে চালের উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ১৫ লাখ ৬৯ হাজার মেট্রিক টন, যা সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। ২০০৮-০৯ সালে যেখানে মোট খাদ্যশস্য (চাল, গম, ভুট্টা) উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ২৮ লক্ষ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে ৪ কোটি ৬৬ লক্ষ ৮৮ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে।
> বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ এবং আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম স্থানে রয়েছে।
> দেশি-বিদেশি ফল চাষেও অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে। কফি, কাজুবাদাম, গোলমরিচ, মাল্টা, ড্রাগন ফলসহ অপ্রচলিত ফসলের চাষাবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মোট ফল উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন। ২০০৬ সালে মাথাপিছু ফল গ্রহণের হার ছিল ৫৫ গ্রাম, যা বেড়ে ২০২৩ সালে এ হয়েছে ৮৫ গ্রাম।
> বিগত ১৫ বছরে দেশে উদ্ভাবিত হয়েছে ৬৯৯টি বৈরী পরিবেশে সহনশীল, উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল এবং প্রায় ৭০৮টি প্রযুক্তি।
> সার, বীজ, কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ বিতরণে সুশাসন নিশ্চিত করা হয়েছে। কৃষি উপকরণের দাম কমানো হয়েছে এবং তা কৃষকের দোরগোড়ায় পৌছে দেওয়া হচ্ছে। কৃষকের উৎপাদন খরচ নিম্নপর্যায়ে রাখতে সরকার ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সার, বিদ্যুৎ, সেচ ইত্যাদি খাতে মোট ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়েছে।
> কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিকে আধুনিকায়ন করার কাজ চলছে। কৃষিযন্ত্রের ক্রয়মূল্যের ওপর ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হয়, যার ফলে কৃষক কম মূল্যে যন্ত্রপাতি কিনতে পারছে। ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার, সিডার, পাওয়ার টিলারসহ প্রায় ১ লক্ষ ৩৩ হাজার কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। তিন হাজার কোটি টাকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলমান আছে।
> খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি কর্মসূচির অগ্রাধিকার অপরিহার্য। বাণিজ্যিক কৃষি বিস্তারের জন্য উচ্চমূল্যের রপ্তানিমুখী ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। অনাবাদি জমি এবং পাহাড়, হাওর, বাঁওড়, উপকূলীয় অঞ্চল ও সকল প্রতিকূল এলাকায় অনাবাদি জমিতে চাষাবাদ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।
> পানিসম্পদ ও সৌরশক্তির সুষ্ঠু ব্যবহার এবং উত্তম কৃষিচর্চার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। দেশের কৃষিব্যবস্থা 'জীবন নির্বাহী' কৃষি থেকে 'বাণিজ্যিক কৃষি'তে রূপান্তরিত হচ্ছে।
অঙ্গীকার
> 'সবার জন্য খাদ্য' আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য ও অঙ্গীকার। কৃষি, কৃষক-কৃষানি ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য প্রণীত প্রেক্ষিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন কৌশল অনুসরণের ধারা অব্যাহত থাকবে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা পূরণ, সকল মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিসম্মত খাদ্য সরবরাহ ও প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, বাণিজ্যিক কৃষির বিকাশ, কৃষিনির্ভর শিল্পের প্রসার, গ্রামীণ ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন, কৃষি ও অকৃষিজ পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বহুমুখীকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এই কৌশলের লক্ষ্য। বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হবে।
> কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার বিবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যা আগামীতে সম্প্রসারিত হবে। কৃষিঋণ সহজলভ্য ও সহজগম্য করার লক্ষ্যে ৪ শতাংশ রেয়াতি সুদে কৃষিঋণ দেওয়া অব্যাহত থাকবে: কেন্দ্রীয় ব্যাংক ০.৫ শতাংশ হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে পুনঃঅর্থায়ন করবে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণে আরো উৎসাহিত হবে।
> দেশে ক্ষুদ্র কৃষকদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৫৪ লক্ষ ৮১ হাজার ৩৫০ জন এবং কৃষি ক্ষুদ্র কৃষকনির্ভর। কৃষি উপকরণে বিনিয়োগের জন্য ক্ষুদ্র কৃষকদের সম্পদ অপ্রতুল। কৃষির জন্য সহায়তা ও ভর্তুকি তথা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি উপকরণে বিনিয়োগ সহায়তা প্রদান আওয়ামী লীগ অব্যাহত রাখবে।
> আওয়ামী লীগ সরকার ইতোমধ্যেই কৃষি উৎপাদন আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে সকল জমি আবাদের আওতায় আনার নীতি বাস্তবায়ন করছে। কোনো জমিই অনাবাদি থাকবে না।
> কৃষিতে শ্রমিকসংকট লাঘব এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সহজে ব্যবহারযোগ্য কৃষি যন্ত্রপাতি সহজলভ্য ও সহজপ্রাপ্য করা হবে। কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত থাকবে।
> সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলায় গুরুত্বারোপ করা হবে।
> কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে।
> বাণিজ্যিক কৃষি, জৈবপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ন্যানো- টেকনোলজিসহ গ্রামীণ অকৃষিজ খাতের উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন মোকাবিলায় উপযুক্ত কর্মকৌশল গ্রহণ করা হবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষির আধুনিকায়ন, প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষি গবেষণার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ অব্যাহত থাকবে।
> স্থানীয় পর্যায়ে বহুবিধ ব্যবহার উপযোগী কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন ও ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ উদ্যোগ উৎসাহিত করা হবে।
> কৃষিপণ্যের দক্ষ সাপ্লাই চেইন ও ভ্যালু চেইন গড়ে তোলার সবিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এবং সহায়তা প্রদান অব্যাহত থাকবে।
> সফলতম ও কর্মক্ষম কৃষিবিজ্ঞানীদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
> বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় উপযুক্ত কর্মকৌশল প্রণয়ন করা হবে। একই সঙ্গে বিশ্বায়নের ফলে সৃষ্ট সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা হবে।
সূত্র : ঢাকাপোস্ট।