ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত আত্মপ্রকাশ কোনো জাতিসত্তার পরিচয়ের পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করে। বহুজাতিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উদার-সহনশীল আধুনিক রাষ্ট্র কানাডার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষিতে মে মাস একটি ব্যতিক্রমী মাস হিসেবে বিবেচিত হয়। মাসটি কানাডার এশিয়ান হেরিটেজ মাস। এই মাসে কানাডায় বসবাসরত বৃহত্তর এশিয়ান বংশোদ্ভূত অভিবাসীদের কয়েক শ বছরের নিরলস অবদান, আত্মত্যাগ, টিকে থাকার সংগ্রাম, স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যময় বর্ণিল সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্যের প্রতি বিশেষ সম্মান স্বরূপ সরকারি-বেসরকারি সংগঠনে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলোচনা ও অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
কানাডায় এশিয়ান হেরিটেজ মাসের মূলমন্ত্র অনেকটাই ১৫০ বছরের বেশি সময় আগের কানাডার পশ্চিমে ওয়েস্ট কোস্টে সুবিস্তৃত ট্রান্স কানাডা প্যাসিফিক রেলওয়ের স্থাপন কাজে চীন থেকে আসা অসংখ্য অভিবাসী কর্মীদের নিরলস শ্রমের সঙ্গে নিগূঢ়ভাবে নিহিত। তবে কানাডার এশিয়ান অভিবাসী বলতে শুধু চায়নিজ নন বরং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম, মধ্য এশিয়া এবং পশ্চিম-এশিয়া থেকে আসা বিরাট জনগোষ্ঠী এর অন্তর্ভুক্ত। এশিয়ান-কানাডীয়রা শুধু কায়িক শ্রমের পাশাপাশি কানাডার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ভারী শিল্প খাত, সাহিত্য, শিক্ষা-গবেষণা, চিকিৎসা, চিত্রকলা, খাদ্য সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল অবদানের মাধ্যমে কানাডার সংস্কৃতি অর্থনীতি ও রাজনীতিকে সমৃদ্ধ রাখছেন প্রতিনিয়ত। এশিয়ান-কানাডীয়দের বৈচিত্র্যময় রীতি ও কৃষ্টির প্রবাহ দীর্ঘ সময়ব্যাপী কানাডার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পথকে মুখরিত করেছে।
কানাডার ইস্ট এশিয়ানরা হলো—চীন, হংকং, জাপান, নর্থ ও সাউথ কোরিয়ান, তাইওয়ানের জনগোষ্ঠী। দক্ষিণ এশিয়ান জনগোষ্ঠী বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের অধিবাসী। সেন্ট্রাল এশিয়ানরা হলো—আফগানিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমিনিস্তান ও উজবেকিস্তানের। কানাডার সাউথ ইস্ট এশিয়ানরা হলো—ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে আসা জনগোষ্ঠী। পশ্চিম-এশিয়ানরা হলো—আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বাহরাইন, সাইপ্রাস, ইরান, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন ও তুরস্কের।
ইতিপূর্বে ১৯৭৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এশিয়া হেরিটেজ মাস উদ্যাপিত হলেও দীর্ঘ সময় পুরো কানাডায় মূলধারার সংস্কৃতিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে এশিয়ানদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। কানাডার কয়েকটি প্রদেশে পৃথকভাবে বিগত বছরগুলো এশিয়ান অভিবাসীদের বিভিন্ন ঐতিহ্যভিত্তিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হলেও দীর্ঘ সময় সার্বিকভাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসেনি। সেই বিবেচনায় কানাডায় প্রথম এশিয়ান বংশোদ্ভূত সিনেটর ভিভিয়ান পোয়ে কানাডায় বৃহত্তর এশিয়ান অভিবাসীদের অবদানের ও ঐতিহ্যগত স্বীকৃতির স্বপক্ষে ২০০১ সালে এশিয়ান হেরিটেজ মাস প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদ্যাপনের বিষয়টির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাঁর প্রস্তাবের ধারাবাহিকতায় কানাডা সরকার ২০০২ সালে মে মাসকে আনুষ্ঠানিক প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে কানাডার এশিয়ান হেরিটেজ মাস হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। সেই অনুসারে মে মাস কানাডায় সাড়ম্বরে উদ্যাপিত হয় এশিয়ান হেরিটেজ মাস।
কানাডার বৃহত্তর এশিয়ান অভিবাসী জনগোষ্ঠীর সাহিত্য-সংস্কৃতি, খাদ্য, পোশাক, বার্ষিক ধর্মীয় উৎসব পালনসহ ইতিহাস ও সংস্কৃতির বহুমুখী দিক এবং কানাডার এশিয়ান অভিবাসীদের অর্জন, টিকে থাকার ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলোচনাসহ অনুষ্ঠানের বিভিন্ন আয়োজন হয়। এভাবে কানাডার মূলধারার সংস্কৃতির সঙ্গে জাতিগোষ্ঠীর বহুমাত্রিক মত, কৃষ্টি, সংস্কৃতির সংযোজনের মাধ্যমে ভিন্ন রীতির প্রতি সহনশীলতা ও সহমর্মিতার শিক্ষা, শ্রদ্ধাবোধ আর যোগসূত্র স্থাপনের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়।
ঐতিহ্যগত আয়োজনের ধারাবাহিকতায় শুধু মে মাস নয়, বছরব্যাপী কেবল সাংস্কৃতিক কৃষ্টির আদানপ্রদান নয়, একই সঙ্গে কানাডার এশিয়ান অভিবাসীদের প্রতি সৃষ্ট যেকোনো মাত্রার বর্ণ ও ধর্মভিত্তিক যেকোনো বিভাজনের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। বর্তমান সময়ে কিছুটা হলেও এশিয়ানদের প্রতি যে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ বিরাজমান তা নিরসনে অতি সম্প্রতি সিনেটর ভিভিয়ান পোয়ে এবারের এশিয়ান হেরিটেজ মাসের এক আলোচনায় বিষয়টি দুঃখজনক হিসেবে অভিহিত করেন আর নিরসনের লক্ষ্যে সবাইকে কাজ করে যাওয়ায় আহ্বান জানিয়েছেন।
এ বছর কানাডার এশিয়ান হেরিটেজ মাসের মূল প্রতিপাদ্য ছিল—‘Recognition, Resilience and Resolve’। এর অর্থ হলো—স্বীকৃতি, সহনশীলতা, মীমাংসা ও সমাধান। কানাডায় শুধু এশিয়ান নয় অন্যান্য জাতি যেমন আফ্রিকান, গ্রিক, কানাডার ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, জুইশ ও ডাচসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর হেরিটেজের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন আয়োজন করা হয়।