নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে হরতাল-অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। এসব কর্মসূচি চলাকালে প্রায় প্রতিদিনই বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলেও রেলে বড় ধরনের নাশকতার চেষ্টা করছে দুর্বৃত্তরা। রেলে নাশকতায় ইতোমধ্যে আগুনে পুড়ে অবুঝ শিশুসহ পাঁচজন নিহত হলেও আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশতাধিক। রেলকে টার্গেট করে বড় ধরনের নাশকতার মাধ্যমে নির্বাচন বানচালে একটি গোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করছেন।
রেলওয়ের এক হিসেবে দেখা গেছে ২৮ অক্টোবর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে বড় ধরনের ৮টি নাশকতা বা দুর্ঘটনা ঘটায় দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনায় সরকারি এই সংস্থাটির প্রায় ৯ কোটি টাকার ক্ষতি সাধন হয়েছে। এ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জেলা পর্যায়েও রেলে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে।
রেলে নাশকতার জন্য ভাড়ায় লোক খাটানো হচ্ছে। মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসসহ দেশব্যাপী রেলে নাশকতার যেসব ঘটনা ঘটেছে তার একটাই উদ্দেশ্য তা হলো নির্বাচন বানচাল করা। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সজাগ রয়েছে। ডিবি পুলিশ ও সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলো সমন্বয় করে পুরো রেলওয়ে কীভাবে পরিকল্পিত নিরাপত্তার আওতায় আনা যায় সে বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে বলেও জানান
পশ্চিম রেলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার। রেলওয়ে পশ্চিম রাজশাহীর রেল শ্রমিক নেতা এমএ আক্তার বলেন,
২৮ অক্টোবর পল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশের পর থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে চোরাগোপ্তা হামলা, যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগ বা বিভিন্ন স্থানে নাশকতার চেষ্টা করছে দুর্বৃত্তরা। তারা বাংলাদেশ রেলওয়েকে টার্গেটে পরিণত করে।
সব শেষ গত মঙ্গলবার ভোরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুনের ঘটনায় পুড়ে যায় তিনটি বগি। যাত্রী ভর্তি ওই ট্রেনে আগুনে পুড়ে মারা যান এক শিশুসহ চারজন।
রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল সূত্র বলছে, ৩১ অক্টোবর গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে হাইটেক সিটি অংশে মৌচাকে রেলওয়ে ২৬ নম্বর সেতুর অ্যাপে টায়ার জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ১৪ নম্বর সেতুতে রেলের ফিসপ্লেট ও বোল্ড খুলে ফেলা হয়। মৌচাকে ককটেলের বিস্ফোরণ এবং পাথর নিক্ষেপ করেও রেল চলাচল বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা।
এ ছাড়া অবরোধের সময় ১ নভেম্বর ঈশ্বরদী ও ঈশ্বরদী বাইপাস সেকশনে মৈত্রী এক্সপ্রেসের ট্রেনের ইঞ্জিন লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারা হয়। হামলায় লোকোমোটিভের জানালার কাচ ভেঙে যায়। এর আগে ২৭ অক্টোবর ঈশ্বরদী ওয়াস্পিড (রেল ধোয়ামোছার কাজ যেখানে করা হয়) লাইনে যাওয়ার সময় একটি ট্রেনের কোচে আগুন ধরিয়ে দিলে কয়েকটি সিট পুড়ে যায়। ১৫ ডিসেম্বর উত্তরা এক্সপ্রেস জয়পুরহাট স্টেশনে ঢোকার সময়ও একটি কোচে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।
রেলের পূর্বাঞ্চল সূত্র বলছে, গত ১৬ নভেম্বর রাতে টাঙ্গাইল স্টেশনে টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের কোচে আগুন দেওয়া হয়। ট্রেনটি সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। দুদিন পর ১৯ নভেম্বর রাতে জামালপুরে সরিষাবাড়ী স্টেশনে থেমে থাকা যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়। এ সময় দুটি কোচ পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২২ নভেম্বর রাতে সিলেট রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ঢাকাগামী উপবণ এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি কোচে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। রাতে ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। তবে দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলায় তেমন কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এ ঘটনার পর দুর্বৃত্তরা আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে ট্রেনের নাশকতায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
১৩ ডিসেম্বর রেলওয়ের ভাওয়াল গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুর সেকশনে ২০ ফুট লাইন কেটে ফেলে দুর্বৃত্তরা। ফলে দুর্ঘটনায় পতিত হয় একটি ট্রেন। লাইন থেকে ট্রেনের ইঞ্জিন এবং ছয়টি কোচ ছিটকে পড়ে। এ ঘটনায় একজনের ঘটনাস্থলে মৃত্যু হলেও বিভিন্ন শ্রেণীপেশার অনেক যাত্রী আহত হন। পরে পুলিশ ও সরকারের অন্যান্য সংস্থা এবং ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। এরপর প্রায় পাঁচ ঘণ্টা শেষে ঢাকা- ময়মনসিংহ রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এ দুর্ঘটনা দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি স্থান পায়।
সব শেষ গত মঙ্গলবার ভোরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুনের ঘটনায় পুড়ে যায় তিনটি বগি। যাত্রী ভর্তি ওই ট্রেনে আগুনে পুড়ে মারা যান এক শিশুসহ চারজন। কমলাপুর রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফেরদৌস বিশ্বাস জানান, এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও কাজ করছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় তেজগাঁও স্টেশন ও আশপাশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাঁচটি সিসিটিভির ভিডিও সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে কাজ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা। তবে ট্রেনটি দাঁড়ানোর পর যেখানে ছিল বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা যেখানে ঘটে সেখানে সরাসরি কোনো সিসি ক্যামেরা ছিল না। এ কারণে নাশকতাকারীদের শনাক্ত করতে বেগ পেতে হচ্ছে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের।
রেলওয়ের পুলিশ বলছে, সারাদেশে রেলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। রেলের নিজস্ব বাহিনীসহ, পুলিশ ও ২৭০০ আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও সার্বিক নিরাপত্তা নজরদারিতে রেখেছে। এছাড়া নিজস্ব সোর্স দিয়েও এলাকাভিত্তিক রেললাইন বা কোনো দুষ্কৃতিকারী অবস্থান করছে কিনা খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি যারা এ ধরনের নাশকতা কিংবা অগ্নিসংযোগের ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
কমলাপুর,চট্রগ্রাম, কুমিল্লা,ময়মনসিংহ, ব রাজশাহী,পাবনার ঈশ্বরদী,যশোর, খুলনা,রংপুর স্টেশনসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে নাশকতাকা অভিযোগে প্রায় ৮০ জনকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে গ্রেফতারকৃতদের অনেকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অপরাধ স্বীকার করেছে।
কমলাপুর,চট্রগ্রাম, সিলেট,কক্সবাজার, কুমিল্লা,ময়মনসিংহ, বিমানবন্দর, রাজশাহী,পাবনার ঈশ্বরদী,যশোর, খুলনা,রংপুর স্টেশনসহসহ দেশের গুরুত্বপূর্ন স্টেশন গুলোথেকে থেকে প্রতিদিন প্রায় শতাধিক ট্রেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলাচল করে। প্রতিটি ট্রেনে ১২ থেকে ১৫টি বগি থাকে। এসব বগিতে হাজার হাজার যাত্রী দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাতায়াত করেন। জনবহুল এ যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধরনের নাশকতা করতে পারলে সেক্ষেত্রে শুধু নির্বাচনই বন্ধ হবে না, দেশ-বিদেশে এটি প্রচার হবে। এর মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলা যাবে। এ কারণে সরকারের পদত্যাগের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছে একটি মহল।
গত ৩০ নভেম্বর রাতে কমলাপুর ৮ নম্বর প্লাটফর্মে আগুন দিতে গিয়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হন আলামিন। তিনি পেশায় বাসচালক হলেও গ্রেফতারের পর পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বড় ভাইদের নির্দেশে ২০ হাজার টাকা ভাড়ায় তিনি ট্রেনের বগিতে আগুন দিতে এসেছিলেন।
অন্যদিকে তেজগাঁওয়ের নাশকতার ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। তারা বিএনপি'র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ ছাড়াও এলিট ফোর্স র্যাবও এ ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে কয়েকজনকে আটক করেছে।
রেলওয়ের এক হিসেবে দেখা গেছে ২৮ অক্টোবর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে বড় ধরনের ৮টি নাশকতা বা দুর্ঘটনা ঘটায় দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনায় সরকারি এই সংস্থাটির প্রায় ৯ কোটি টাকার ক্ষতি সাধন হয়েছে। এ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জেলা পর্যায়েও রেলে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। আশার কথা, রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্তকতা এবং স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় সেসব দুর্ঘটনা থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাওয়া গেছে।